ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের স্টারশিপ রকেটকে লঞ্চ প্যাডে অবতরণের কৌশল ও প্রযুক্তি বিজ্ঞানচর্চার এক অসাধারণ উদাহরণ। এই সাফল্যের মূল ভিত্তি হলো পদার্থবিজ্ঞানের নানান শাখার দক্ষ প্রয়োগ। ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স, এরোডাইনামিক্স, তাপগতিবিদ্যা এবং উন্নত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার (control systems) মেলবন্ধনে এই প্রযুক্তিগত অর্জন সম্ভব হয়েছে। চলুন দেখে নেওয়া যাক কীভাবে পদার্থবিজ্ঞানের মূল ধারণাগুলো এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
SpaceX successfully catches a rocket booster at its launch pad in a novel engineering feat https://t.co/pKouAMcyrD pic.twitter.com/IrSxU4i5Si
— Reuters (@Reuters) October 14, 2024
থ্রাস্ট এবং রকেট প্রপালশন
স্টারশিপের র্যাপ্টর ইঞ্জিনগুলো রকেটকে লঞ্চ এবং অবতরণের সময় প্রয়োজনীয় শক্তি (thrust) সরবরাহ করে। এটি সম্পূর্ণভাবে নিউটনের তৃতীয় সূত্রের উপর নির্ভর করে: প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। ইঞ্জিনের নিম্নমুখী গ্যাস নির্গমন রকেটকে উর্ধ্বমুখী ঠেলে দেয়। একইভাবে, অবতরণের সময় ইঞ্জিনগুলো বিপরীতমুখী থ্রাস্ট তৈরি করে রকেটের গতি কমায়, যা নিরাপদ অবতরণ নিশ্চিত করে।
গাইডেন্স ও নেভিগেশন
স্টারশিপকে লঞ্চ প্যাডে ফিরিয়ে আনতে নিখুঁত গতিপথ (trajectory) নির্ধারণ করতে হয়। এর জন্য ব্যবহার করা হয় নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র (বল = ভর × ত্বরণ), যা রকেটের গতি ও ত্বরণ নিয়ন্ত্রণ করে।
রকেটের অবস্থান, উচ্চতা এবং বায়ুর প্রতিরোধ (drag) হিসাব করে ইঞ্জিনগুলোকে সঠিক সময়ে এবং কোণে চালনা করা হয়। এছাড়া, গাইডেন্স সিস্টেম মহাকর্ষীয় বল এবং বাতাসের চাপের মতো প্রাকৃতিক প্রভাব বিবেচনা করে অবতরণকে যথাযথ করে তোলে।
এরোডাইনামিক্স
রকেটের আকৃতি এবং এর পাখনাগুলো বায়ু প্রতিরোধ কমানো এবং বায়ুমণ্ডলে গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। স্টারশিপ একটি “বেলি ফ্লপ” কৌশল ব্যবহার করে, যেখানে এটি শরীরের ফ্ল্যাট দিকটি নিচের দিকে রেখে ধীরে ধীরে অবতরণ করে। এই প্রক্রিয়াটি ড্র্যাগ বাড়িয়ে রকেটের গতি কমায় এবং জ্বালানি খরচও সাশ্রয়ী করে।
তাপগতিবিদ্যা
বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময়, স্টারশিপ প্রচণ্ড তাপের সম্মুখীন হয়। উচ্চ গতির কারণে বাতাস সংকুচিত হয় এবং ঘর্ষণ (friction) তৈরি হয়, যা রকেটের তাপমাত্রা কয়েক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।
স্টারশিপ একটি তাপ প্রতিরোধী শিল্ড (heat shield) ব্যবহার করে, যা তাপগতিবিদ্যার (thermodynamics) প্রয়োগে তৈরি। এটি রকেটকে তাপ থেকে রক্ষা করে এবং নিরাপদে পুনঃপ্রবেশ নিশ্চিত করে।
গতিশক্তি এবং নিয়ন্ত্রিত অবতরণ
রকেট যখন ফ্রি-ফল অবস্থায় থাকে, তখন এটি গতিশক্তি (momentum) ধরে রাখে। নিয়ন্ত্রিত অবতরণের জন্য ইঞ্জিনগুলো সঠিক সময়ে সক্রিয় করা হয়। ইঞ্জিনের কার্যকরী ব্যবহারের মাধ্যমে রকেটের গতি কমিয়ে নির্দিষ্ট লঞ্চ প্যাডে নিরাপদ অবতরণ সম্ভব হয়।
শক্তির দক্ষ ব্যবহার
জ্বালানির সাশ্রয় মহাকাশ গবেষণার একটি প্রধান লক্ষ্য। স্টারশিপের অবতরণের প্রোফাইল এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে এটি উচ্চতা থেকে প্রাপ্ত স্থিতিশক্তি (potential energy) এবং গতি থেকে প্রাপ্ত গতিশক্তি (kinetic energy) সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পারে।
উন্নত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
স্টারশিপের কম্পিউটারাইজড নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় জাইরোস্কোপ, জিপিএস এবং অন্যান্য সেন্সর রয়েছে, যা রকেটের গতি এবং অবস্থান ক্রমাগত বিশ্লেষণ করে। ফিডব্যাক লুপ এবং অটোমেশন ব্যবহার করে রকেটটি অবতরণের সময় রিয়েল-টাইমে সিদ্ধান্ত নেয়।
রকেট পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা
স্পেসএক্সের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো রকেট পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা। এটি মহাকাশ ভ্রমণের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনে। স্টারশিপের লঞ্চ প্যাডে ফিরে আসার জন্য উচ্চমাত্রার নির্ভুলতা প্রয়োজন, যা পদার্থবিজ্ঞানের মডেলিং এবং পরীক্ষামূলক ডিজাইনের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।
সংক্ষেপে বলা যায় যে, স্পেসএক্স স্টারশিপ রকেটকে লঞ্চ প্যাডে ফিরিয়ে আনতে পদার্থবিজ্ঞানের মূলনীতি এবং উন্নত প্রযুক্তির মেলবন্ধন ব্যবহার করা হয়েছে। থ্রাস্ট, গতিশক্তি, তাপগতিবিদ্যা এবং এরোডাইনামিক্সের সঠিক প্রয়োগ স্টারশিপকে একটি “সায়েন্স ফিকশন” ধারণা থেকে বাস্তবতায় রূপান্তর করেছে। এই প্রযুক্তিগত সাফল্য ভবিষ্যতের মহাকাশ গবেষণার পথ আরও মসৃণ করবে।