রোজা আসলেই শবে কদরের নামাজ আদায় করার কথা মনে আসে। কুরআনের ভাষায় এটিকে ‘লাইলাতুল কদর’ বলা হয় (Shab-e-Qadr – lailatul qadr namaz)। লাইলাতুল কদর আরবি শব্দ যার অর্থ হলো বরকতময়, সম্মানিত বা মহামান্বিতরাত রাত। ফারসি ভাষায় একে শবে কদর বলা হয়। শবে কদর বা লাইলাতুল কদর রাত হল রমজান মাসের শেষ দশ দিনের যেকোনো একটি বিজোড় তারিখ সম্বলিত ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯তম রাত।
শবে কদর কি?
শবে কদরের নামাজ হল একটি বিশেষ প্রার্থনার রাত যা মুসলমানরা রমজানের শেষ ১০ রাতের বিজোড় রাতে পড়ার জন্য আহাবান করা হয়। এটি একটি নফল নামাজ, যা দুই রাকাত করে নিয়মিত নামাজের মতোই করা হয়।
আরও পড়ুন:
- ১১টি শ্রেষ্ঠ তাসবিহ, দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করুন
- তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার সঠিক নিয়ম
- গুনাহ মাফের দোয়া, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া
পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা কোরআন নাজিল করেছেন। রমজান মাসের একটি রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ হেরা গুহায় আল্লাহর ফেরেশতা অহী নিয়ে এসেছিলেন । এই রাতকেই শবে কদর বা লাইলাতুল কদর রাত বলা হয় ।
#সূরা দুখানের ৩নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি এই কুরআনকে এক বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। (সূরা দুখান-৩)
গুরুত্বপূর্ণ এই রাতের ফজিলত সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা কদর নাজিল করেছেন।
সূরা কদর বাংলা অনুবাদ, আরবি উচ্চারণ ও অর্থ
(১)إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ
উচ্চারণঃ ইন্নাআনঝালনা-হু ফী লাইলাতিল কাদর।
অর্থঃ আমি একে নাযিল করেছি শবে-কদরে।
(২)
وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ
উচ্চারণঃ ওয়ামাআদরা-কা-মা-লাইলাতুল কাদর।
অর্থঃ শবে-কদর সমন্ধে আপনি কি জানেন?
(৩)لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ
উচ্চারণঃ লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহর।
অর্থঃ শবে-কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
(৪)تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ
উচ্চারণঃ তানাঝঝালুল মালাইকাতুওয়াররুহু ফীহা-বিইযনি রাব্বিহিম মিন কুল্লি আমর।
অর্থঃ এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে।
(৫)سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ
উচ্চারণঃ ছালা-মুন হিয়া হাত্তা-মাতলা’ইল ফাজর।
অর্থঃ এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
Qadr prayer niyat English – শবে কদরের নামাজের ইংরেজি নিয়ত
“I intend to perform two rak’ahs of Qadr prayer for the sake of Allah and seeking His pleasure. Allahu Akbar.”
Note: It’s important to make the niyat or intention in your heart before starting the prayer.
“মূলত নিয়ত হল আপনার মন থেকে কেবলামুখি দাড়িয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নামাজ পড়ার ইচ্ছা।” দ্রষ্টব্য: অনেকেই বলে থাকেন যে, আরবি ভাষায় নিয়ত বলা ভাল, কারণ এটি কোরআন এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ভাষা।
শবে কদর নামাজের নিয়ত আরবিতে:
“নাওয়াইতুআন্ উছল্লিয়া লিল্লা-হি তা‘আ-লা- রাক‘আতাই ছালা-তি লাইলাতুল কদর-নাফলি, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা-জিহাতিল্ কা‘বাতিশ্ শারীফাতি আল্লা-হু আকবার”।
শবে কদর নামাজের বাংলা নিয়ত:
“আমি ক্বেবলামূখী হয়ে আল্লাহ্ এর উদ্দেশ্যে শবে কদরের দু‘রাক‘আত নফল নামাজ আদায়ের নিয়ত করলাম- আল্লাহু আকবার”।
শবে কদরের নামাজ কত রাকাত :
শবে কদরের নামাজ দু‘রাকাত করে যত বেশী পড়া যায় তত বেশি ছওয়াব। নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা পড়ার পর সূরা ইখলাছ, সূরা ক্বদর, আয়াতুল কুরছী বা সূরা তাকাছুর ইত্যাদি মিলিয়ে পড়া অধিক ছওয়াবের কাজ। এই ভাবে কম্পক্ষে ১২ রাকাত নামাজ আদায় করা উত্তম। এর বেশি যত রাকাত আদায় করা যায় ততই ভালো।
কেউ যদি উপরে উল্লেখিত সূরাগুলো না পারেন তাহলে সূরা ফাতিহা পড়ার পর যে সূরাগুলো আপনি পারেন তার মধ্য থেকে প্রতি রাকাতে একটি করে সূরা মিলিয়ে নিতে হবে। এই ভাবে কমপক্ষে ১২ রাকাত নামাজ আদায় করা উত্তম। এর বেশি যত রাকাত আদায় করা যায় ততই ভালো।
প্রতি ৪ রাকাত পর পর কিছু তাসবিহ-তাহলীল আদায় করে মহান আল্লাহর নিকট দোয়া কামনা করা অতি উত্তম। এই ভাবে সারা রাত নামাজ আদায় করা যেতে পারে।
জিকির ও দোয়া: হাদিসে যে দোয়া ও জিকিরের অধিক ফজিলতের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো থেকে কয়েকটি নির্বাচিত করে অর্থ বুঝে বারবার পড়া যেতে পারে। ইস্তেগফার ও দরুদ আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। কমপক্ষে ১০০ বার ইস্তেগফার ও ১০০ বার দরুদ পড়া যেতে পারে।
এই রাতে ইবাদত করার মর্যাদা সারাজীবন ইবাদত করার চেয়ে আরো অনেক বেশি। এটা এমন এক রাত যেখানে সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত মহান আল্লাহর বিশেষ রহমত এবং শান্তি বর্ষিত হতে থাকে।
লাইলাতুল কদর ইসলামের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতময় রাতগুলোর একটি। মুমিন বান্দাদের কাছে এটি সেই শক্তির রাত, যখন নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়। এছাড়াও রয়েছে কোরআনের ১০টি শ্রেষ্ঠ দোয়া, যা শুধুমাত্র এই রাতের জন্য নয়, প্রতিদিন পড়ে আল্লাহর কাছে বাংলা অথবা ইংরেজিতে মোনাজাত বা দোয়া করা যায়। যারা আরবি দোয়া জানেন তারা আরবিতেও করতে পারেন।
শবে কদরের ফজিলতঃ
এ রাতের ফজিলত অন্য যেকোনো রাতের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। বলা যেতে পারে- এ রাত হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে যত বেশি নফল নামাজ আদায় করবেন তত বেশি সওয়াব।
শবে কদর সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ বলেন:
“নিশ্চয়ই আমি (কোরআন)কে অবতীর্ণ করেছি এই মর্যাদাপূর্ণ রাত্রিতে (লাইলাতুল কদরে)। আর মর্যাদাপূর্ণ রাত্রি সম্বন্ধে আপনি কি জানেন? মর্যাদাপূর্ণ রাত্রি হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। ঐ রাত্রিতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরীল) অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময় সেই রাত্রি ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত।” (সূরা কদর)
হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ৪ রাকাত নামাজ ক্দরের রাতে আদায় করবে এবং উক্ত নামাজের প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর ২১ বার করে সূরা ইখলাছ পাঠ করবে, আল্লাহ তা’য়ালা ওই ব্যক্তিকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ করে দেবেন এবং বেহেশতের মধ্যে এক মনোমুগ্ধকর মহল তৈরি করে দেবেন।
অপর এক হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, হযরত রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ক্দরের রজনীতে ৪ রাকাত নামাজ আদায় করবে এবং উহার প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা কদর ও সূরা ইখলাছ তিনবার করে পাঠ করবে, নামাজ শেষে সিজদায় গিয়ে নিম্নের দোয়াটি কিছু সময় পাঠ করে আল্লাহর দরবারে যা-ই প্রার্থনা করবে তিনি তাই কবুল করবেন এবং তার প্রতি অসংখ্য রহমত বর্ষিত করবেন।
দোয়াটি হলো: সুবহানাল্লাহি ওয়াল হামদু লিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার
سُبْحَانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ للهِ وَلَا إلَهَ إلّا اللهُ، وَاللهُ أكْبَر
অর্থ: আমি আল্লাহতায়ালার গুণকীর্তন করছি, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতায়ালার জন্য, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো মাবুদ নেই, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।
শবে কদরে যে দোয়াটি সবচেয়ে বেশি পড়ার জন বলা হয়েছে :
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! (সা.) আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন; তুমি বলবে,
اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।’
‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (ইবনে মাজাহ: ৩৮৫০)
শবে কদরের রাত কবে ?
এই সম্পর্কে কোথাও নিদির্ষ্ট করে কোন তারিখ উল্লেখ করা নাই। তবে, হাদিস শরিফ ও আলেমদের অভিমত হল, ২০ রমজানের পর যেকোনো বিজোড় রাত শবে কদরের রাত হতে পারে। তবে ২৬ রমজানের দিবাগত রাতকেই লাইলাতুল কদরের রাত হিসাবে মুসল্লিরা পালন করে আসছেন।
- লাইলাতুল কদরে কি দোয়া করবেন?
লাইলাতুল কদর রাতে মুসলমানরা আল্লাহর কাছে দোয়া ও ক্ষমা চেয়ে অতিরিক্ত নামাজ (নফিল) আদায় করে। এই বরকতময় রাতে কুরআন তেলাওয়াত, যিকির (আল্লাহর স্মরণ) এবং দুআ (দোয়া) করার জন্য উত্সাহিত করা হয়।
- লাইলাতুল কদরের জন্য কত রাকাত নামাজ পড়েন?
সাধারণত লাইলাতুল কদরে নির্দিষ্ট করে কোন রাকাত নামাজ নেই। যার যত ইচ্ছা নফল নামাজ আদায় করতে পারে।
- লাইলাতুল কদর নামাজের দোয়া কি?
লাইলাতুল কদরে নির্দিষ্ট কোন দোয়া নেই, মুমিন বান্দারা আল্লাহর রহমত ও রিজিক বৃদ্ধির জন্য দোয়া ও জিকির করে থাকেন, তবে অনেকেই এই দোয়াটি খুব বেশি পড়েন হল:
“আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউউউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি” যার অর্থ “হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাশীল এবং ক্ষমা পছন্দ করেন, তাই আমাকে ক্ষমা করুন।” – “Allahumma innaka afuwwun tuhibbul afwa fa’fu anni” which means “O Allah, You are Forgiving and love forgiveness, so forgive me.”
- শবে কদর কবে, কোন তারিখের রাতে সংঘটিত হয়?
লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশ রাতে, বিশেষ করে মাসের বিজোড় রাতে (২১, ২৩, ২৫, ২৭ বা ২৯ তারিখে) ঘটে বলে বিশ্বাস করা হয়। রমজানের শেষ দশ দিনে অতিরিক্ত ইবাদত, এবং এই ইবাদত করার মাধ্যমে মুসলমানদের শবে কদর রাতের সন্ধান করতে আহবান করা হয়েছে।
- লাইলাতুল কদরে কোন সূরা পড়তে হবে?
লাইলাতুল কদরের সময় মুসলমানরা কুরআনের যেকোনো সূরা পড়তে পারেন। যাইহোক, সূরা আল-কদর পাঠ করার জন্য অত্যন্ত সুপারিশ করা হয়।
- লাইলাতুল কদরের তিনটি সূরা কি কি?
লাইলাতুল কদরে যে তিনটি সূরা সাধারণত পাঠ করা হয় তা হল: সূরা কদর, সূরা আল ইখলাস, সূরা আল ফালাক
- আমি কি মাগরিবের পরে লাইলাতুল কদরের সালাত আদায় করতে পারি?
হ্যাঁ, মাগরিবের পর লাইলাতুল কদরের নামাজ পড়তে পারেন। তবে, রমজান মাসে এশার নামাজের পর তারাবিহ শেষ করে লাইলাতুল কদরের নামায আদায় করা হয়।
[…] […]
[…] বর্ণনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা কদর নাজিল […]
[…] তারাবি শব্দটি বহুবচন। এর একবচন হলো তারবিহ। এর আভিধানিক অর্থ হলো বিশ্রাম, স্বস্তি, শান্তি ও প্রশান্তি। রমজান মাসে এশার নামাজের পর যে সুন্নতে মুয়াক্কাদা ২০ রাকাত নামাজ আদায় করা হয়, তাকে তারাবির নামাজ বলে (Taraweeh prayer)। শবে কদরের নামাজ আদায়ের নিয়ম । […]
[…] […]
[…] […]
[…] […]